দানপত্র দলিল কী?


 দানপত্র দলিল হলো একটি আইনগত নথি, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তার সম্পত্তি অন্য ব্যক্তির নামে হস্তান্তর করেন বিনা মূল্যে ও স্থায়ীভাবে। এটি সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া যা সম্পূর্ণ আইনি ও বৈধ হতে হয়।

দানপত্রের বৈশিষ্ট্য:

  1. স্বেচ্ছায় প্রদান: দাতা তার ইচ্ছায় সম্পত্তি দান করেন, কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়া।
  2. বিনা মূল্যে: এতে কোনো আর্থিক বিনিময় থাকে না।
  3. অবিলম্বে কার্যকর: দান কার্যকর হওয়ার জন্য এটি গ্রহণ করতে হয় এবং দখল গ্রহণ করলেই বৈধ হয়।
  4. আইনগত সুরক্ষা: এটি রেজিস্ট্রি করলে ভবিষ্যতে কোনো বিরোধ হলে আইনগতভাবে প্রতিকার পাওয়া যায়।

দানপত্র দলিল রেজিস্ট্রি খরচ কত?

বাংলাদেশে দানপত্র দলিল রেজিস্ট্রির খরচ নির্ধারিত হয় জমির মূল্য ও অবস্থান অনুযায়ী।

১. সরকারি ফি ও ট্যাক্স:

  • স্ট্যাম্প ডিউটি: ২% (জমির ঘোষিত মূল্যের ওপর)
  • নিবন্ধন ফি: ১%
  • ভ্যাট: ১৫% (নিবন্ধন ফি-এর ওপর)
  • লেখক ও আইনজীবীর ফি: আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হয়

২. নগর ও গ্রামভেদে পার্থক্য:

  • ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো শহরগুলিতে দানপত্র রেজিস্ট্রেশনের খরচ তুলনামূলক বেশি হতে পারে।
  • গ্রামাঞ্চলে জমির মূল্য কম হওয়ায় খরচ কিছুটা কম হয়।

৩. নিকট আত্মীয়ের ক্ষেত্রে ছাড়:

যদি বাবা-মা, ভাই-বোন বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পত্তি দান করা হয়, তাহলে স্ট্যাম্প ডিউটি ১% হয়।

রেজিস্ট্রির প্রক্রিয়া:

  1. দলিল লিখন: দলিল লেখক বা আইনজীবীর মাধ্যমে দানপত্র তৈরি করতে হয়।
  2. স্ট্যাম্প ফি পরিশোধ: নির্ধারিত স্ট্যাম্প ডিউটি ও অন্যান্য চার্জ দিতে হয়।
  3. সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দাখিল: দলিলটি সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে নিবন্ধন করতে হয়।
  4. বায়া ও স্বাক্ষী উপস্থিতি: দাতা ও গ্রহীতার স্বাক্ষরসহ দুইজন স্বাক্ষীর উপস্থিতি প্রয়োজন।
  5. রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন: সব প্রক্রিয়া শেষে দলিল নিবন্ধন হয় এবং আইনগত বৈধতা পায়।

উপসংহার

দানপত্র দলিল হলো বিনা মূল্যে সম্পত্তি হস্তান্তরের একটি বৈধ উপায়, যা রেজিস্ট্রি করলে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। রেজিস্ট্রির জন্য খরচ জমির মূল্যের ওপর নির্ভর করে, তবে নিকট আত্মীয়দের মধ্যে দানের ক্ষেত্রে কম খরচে নিবন্ধন করা যায়।

দানপত্র দলিল কি পরবর্তীতে বাতিল করা যায়?

সাধারণত, দানপত্র দলিল একবার বৈধভাবে রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে তা বাতিল করা যায় না। কারণ, এটি সম্পত্তির স্থায়ী হস্তান্তর এবং একবার দান সম্পন্ন হলে, দাতা তার মালিকানার সব অধিকার হারায়। তবে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে দানপত্র বাতিল করা সম্ভব হতে পারে।

দানপত্র বাতিলের সম্ভাব্য কারণসমূহ:

১. প্রতারণা বা জালিয়াতি হলে:

  • যদি প্রমাণ হয় যে দানপত্র দলিল জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি হয়েছে, তাহলে আদালতের মাধ্যমে এটি বাতিল করা সম্ভব।
  • প্রমাণ করতে হবে: দাতাকে প্রতারণার মাধ্যমে স্বাক্ষর করানো হয়েছে বা ভুল তথ্য দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে।

2. বলপ্রয়োগ বা প্রভাব বিস্তার:

  • যদি দাতা প্রমাণ করতে পারেন যে তাকে জোরপূর্বক, মানসিক চাপ বা ভয় দেখিয়ে দানপত্র তৈরি করানো হয়েছে, তাহলে এটি বাতিল করা যায়।

৩. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে:

  • যদি দানের সময় কোনো শর্ত দেওয়া হয়ে থাকে এবং গ্রহীতা তা না মানে, তাহলে দাতা আদালতে আবেদন করে দানপত্র বাতিল করতে পারেন।
  • উদাহরণ: দাতা শর্ত দিয়েছিলেন যে তিনি জীবিত থাকাকালীন সম্পত্তি ব্যবহার করতে পারবেন, কিন্তু গ্রহীতা তাকে উচ্ছেদ করেন।

৪. দখল গ্রহণ না করলে:

  • হেবা বা দানের ক্ষেত্রে সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য গ্রহীতাকে দখল নিতে হয়।
  • যদি দখল নেওয়া না হয়, তবে দাতা আদালতের মাধ্যমে দানপত্র বাতিল করতে পারেন।

৫. আইনগত ত্রুটি থাকলে:

  • যদি দলিল প্রস্তুতির সময় কোনো আইনি ত্রুটি থাকে (যেমন ভুল তথ্য, স্বাক্ষীর অনুপস্থিতি বা প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করা), তাহলে এটি বাতিল করা যেতে পারে।

কীভাবে বাতিল করতে হয়?

  1. আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।
  2. প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে যে দলিল প্রতারণা, বলপ্রয়োগ বা অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে তৈরি হয়েছে।
  3. আদালত যাচাই-বাছাই করে রায় প্রদান করবে।
  4. আদালতের অনুমোদন ছাড়া দানপত্র বাতিল হয় না।

যেসব ক্ষেত্রে বাতিল করা যায় না:

✅ দাতা ইচ্ছাকৃতভাবে ও স্বেচ্ছায় দলিল রেজিস্ট্রি করলে তা বাতিল করতে পারবেন না।
✅ যদি গ্রহীতা দখল নিয়ে ফেলেন এবং সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন হয়ে যায়, তবে দাতা এটি ফেরত নিতে পারবেন না।
✅ আত্মীয়দের মধ্যে দান করলে এবং পরে মন পরিবর্তন করলে বাতিলের সুযোগ নেই।

উপসংহার

দানপত্র দলিল সাধারণত স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় হয়, তবে প্রতারণা, বলপ্রয়োগ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ বা আইনগত ত্রুটির ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে এটি বাতিল করা সম্ভব। তাই দানপত্র দলিল তৈরির আগে সতর্ক থাকা উচিত এবং আইনি পরামর্শ নেওয়া ভালো।

0 Comments